চীনের উহান নগরী ছিল করোনাভাইরাস মহামারির গ্রাউন্ড জিরো। এই বিশ্ব মহামারির প্রতীকে পরিণত হয়েছিল উহান। কিন্তু প্রায় এক কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যার এই শহরে এখন আবার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে।
হুবেই প্রদেশের সংস্কৃতি এবং পর্যটন দপ্তরের পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে, উহানে ছুটি কাটাতে গেছেন প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ মানুষ।
উহানে যেন এই করোনাভাইরাস এখন অনেক অনেক দূরের স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এই উহানকে বর্ণনা করেছিলেন এক বীর নগরী হিসেবে।
চীনের সরকার বলছে উহান নগরীতে এখন করোনাভাইরাসের একটি সংক্রমণও নেই। তবে অনেক সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞ সরকারের এই বক্তব্যকে একটু সংশয়ের চোখে দেখা উচিত বলে মনে করেন।
উহানের পুনর্জন্ম
চীনে যে ন্যাশনাল ডে গোল্ডেন উইক পালিত হয় তার অংশ হিসেবে কর্তৃপক্ষ উহান ট্রেন স্টেশনে এক ‘ফ্ল্যাশ মব’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই অনুষ্ঠানের একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে দেখা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ সেখানে সমবেত হয়ে গান গাইছে এবং চীনা পতাকা দোলাচ্ছে।
পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য বিভাগের উপ-পরিচালক হুয়া চুনইং বলেন করোনাভাইরাসের পর যেন আরো বেশি প্রাণশক্তি নিয়ে উহানের পুনর্জন্ম হয়েছে।
বিবিসির চীনা বিভাগের হংকং ব্যুরোর সম্পাদক ভিভিয়ান উ বলছেন, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের সহায়তায় সরকার উহানের এমন একটি চিত্র তুলে ধরতে চাইছে যাতে মনে হয় সেখানে সবকিছু স্বাভাবিক আছে।
“হ্যাঁ, ওখানে সবকিছু মনে হচ্ছে স্বাভাবিক। তবে অনেক মানুষ এবং অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকের জন্য ব্যাপারটা ঠিক আগের মতো নয়। সেখানে এখনো অনেক রকমের উদ্বেগ আছে।”
“কিন্তু চীনা প্রচারণা থেকে আমরা এরকম একটা বার্তা পাই যে চীন সরকার করোনাভাইরাস খুব সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে,” বলছেন তিনি।
২৬ অক্টোবর পর্যন্ত চীনে করোনাভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৯১ হাজার ১৫১। আর মারা গেছে পাঁচ হাজারেরও কম।
সেই তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে, যাদের জনসংখ্যা চীনের এক চতুর্থাংশ, সেখানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শিকার হয়েছে ৮৫ লাখের বেশি মানুষ। মারা গেছে ২ লাখ ২৫ হাজার।
“চীনে অনেক নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে। তবে মনে হচ্ছে উহানে নয়। আর সেখানে যদি ঘটেও, সরকার এটা নিশ্চিত করছে যে খুবই দ্রুততা এবং দক্ষতার সঙ্গে যেন সেটা দমন করা হয়।”
সরকারের সর্বাত্মক চেষ্টা
চীনের সবচাইতে প্রিয় পর্যটন গন্তব্য হিসেবে উহানের যে পুনর্জন্ম হয়েছে, সেটা দুর্ঘটনাবশত ঘটেনি। এটা হচ্ছে সরকারের জাতীয় এবং আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল।
আগস্ট মাসে হুবেই প্রদেশের সরকার ঘোষণা করে যে প্রদেশের প্রায় ৪০০ অবকাশ কেন্দ্র খুলে দেয়া হবে সারাদেশের পর্যটকদের জন্য এবং লোকে সেখানে বিনামূল্যে থাকতে পারবে।
তবে এসব পর্যটন কেন্দ্রে ধারণক্ষমতার অর্ধেক মানুষকেই কেবল আসতে দেয়া হচ্ছে। আর যারা এখানে বেড়াতে আসবেন তাদের শরীরের তাপমাত্রা মেপে দেখা থেকে শুরু করে নানা রকম নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে। কিন্তু তারপরও এসব পর্যটনকেন্দ্র সফরের জন্য বিপুল সাড়া পড়ে গিয়েছিল। এরকম বিপুল সাড়া ছিল অপ্রত্যাশিত।
ন্যাশনাল গোল্ডেন উইকে যে সমস্ত পর্যটক উহান সফর করেন তারা সেখানকার ঐতিহাসিক ইয়েলো ক্রেন টাওয়ার দেখতে গিয়েছিলেন। এটি উহান শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে।
এই ইয়েলো ক্রেন টাওয়ারের বর্তমান কাঠামোটি তৈরি করা হয় ১৯৮১ সালে। সেখানে ঢুকতে কোন প্রবেশমূল্য এখন দিতে হচ্ছে না।
চীনের শিনহুয়া বার্তা সংস্থার খবর অনুযায়ী, অন্তত এক হাজার ট্রাভেল এজেন্সি এবং সাড়ে ৩০০ হোটেল সরকারের এই প্রচেষ্টায় শরিক হয়েছে। তারা পর্যটকদের নানা ধরনের ডিসকাউন্ট দিচ্ছে।
একটি পর্যটন নগরী হিসেবে উহানের যে পুনর্জন্ম, সেটাকে চীনা কর্তৃপক্ষের আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ হিসেবে দেখা যেতে পারে, বিশেষ করে যেভাবে তারা এই মহামারি মোকাবেলা করেছেন।
পর্যটন শিল্পের যে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিল, সেটি কাটিয়ে উঠতে এটিকে তারা সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে দেখছেন।
সরকারের বিজয়
তবে এটিকে একই সঙ্গে চীনা সরকারের বিজয়ের প্রতীক হিসেবেও দেখা হচ্ছে। বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের চীন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ভিনন্সেন্ট নাই বলেন, সরকার হয়তো তার প্রপাগান্ডার কাজে উহানকে ব্যবহার করছে। তবে তিনি একই সঙ্গে এটাও বলছেন যে সেখানে পরিস্থিতির আসলেই উন্নতি হয়েছে।
“লোকজন জানে যে ওখানে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। উহানে যদি করোনাভাইরাস থাকতো তাহলে কেউ সেখানে বেড়াতে যেত না,” বলছেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, “চীনারা যে ওখানে বেড়াতে যেতে চাইছে, যেটি কিনা ছিল কোভিড-১৯ মহামারির একেবারে প্রধান কেন্দ্র, সেটা সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে একটা বিরাট বিজয়।”
চীনের পর্যটন শিল্প ধীরে ধীরে আবার চাঙ্গা হতে শুরু করলেও চাইনিজ ট্যুরিজম একাডেমির পূর্বাভাস হচ্ছে ২০২০ সালে পর্যটন থেকে আয় গত বছরের তুলনায় ৫২ শতাংশ কমে যাবে।
ভিনন্সেন্ট নাই বিশ্বাস করেন পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তবে এই স্বাভাবিক অবস্থা টিকবে কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
দ্বি-ধারী তলোয়ার
ভিনসেন্ট নাই বলছেন এই স্বাভাবিক অবস্থার বোধটা সারা দেশজুড়েই ফিরে আসছে। এখন চীনের রাস্তায় মাস্ক পরা লোক আগের তুলনায় অনেক কম দেখা যাচ্ছে। যেমন দুই কোটি মানুষের নগরী বেইজিংয়ে মাস্ক পরা আর বাধ্যতামূলক নয়।
“এতে করে বোঝা যায় পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবে একই সঙ্গে এটা কিন্তু একটা দ্বি-ধারী তলোয়ারের মতো ব্যাপারও হতে পারে। কারণ এই ভাইরাস এখনো পর্যন্ত পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়নি,” বলছেন তিনি।
“এখনো পর্যন্ত এই ভাইরাসের কোনো কার্যকরী টিকা নেই। যদি লোকজন তাদের সতর্কতার মাত্রা কমিয়ে দেয়, তখন করোনাভাইরাসের একটা দ্বিতীয় ধাক্কা খুবই বিপর্যয়কর হতে পারে।”
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে চীন হতে যাচ্ছে বিশ্বের একমাত্র বৃহৎ অর্থনীতি যারা এ বছর ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। ধারণা করা হচ্ছে এই প্রবৃদ্ধি হবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। গত ছয় বছর ধরে চীনের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল গড়ে প্রায় ৬ শতাংশ।
তবে চীনের পর্যটনশিল্প যেখানে অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আলোর আভাস দেখতে পাচ্ছে, অন্যান্য খাতের বেলায় সেটা বলা যাবে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব খাতে এবং জনসংখ্যার অর্থনৈতিকভাবে নাজুক অংশের ওপর একটা বড় ধাক্কা দিয়েছে করোনাভাইরাস মহামারী।
“কেন্দ্রীয় সরকার চেষ্টা করছে অর্থনীতিকে পুরনো ধারায় ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু বড় বড় শহরে তরুণরা কোন কাজ খুঁজে পাচ্ছে না এবং তাদের বাড়ি ভাড়া দেয়ার মতো অর্থ পর্যন্ত পকেটে নেই। সুতরাং অনেকেই শহর ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে,” বলছেন ভিভিয়ান হু।
“অনেক মানুষ হয়তো এখন চীনের নানা এলাকা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে এটা মনে রাখতে হবে এই করোনাভাইরাসের ছায়া কিন্তু এখনো রয়ে গেছে।”
লোকজন তাদের নিত্যদিনের স্বাভাবিক জীবনের ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু এতে সময় লাগবে। আর সেখানে আসলেই কি ঘটছে, তার একটা বস্তুনিষ্ট বর্ণনা পাওয়াও কিন্তু বেশ কঠিন।”
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply